বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান (১৯৫৩-১৯৭১)
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের মিছিলে যে সাত জনের আত্মত্যাগ ও বীরত্বে জাতি তাঁদেরকে 'বীরশ্রেষ্ঠ' খেতাবে ভূষিত করে মরণোত্তর সম্মান দিয়েছে, বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান তাঁদের অন্যতম। ১৯৫৩ সালে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার খোর্দ্দ খালিশপুর গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে তিনি জম্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আক্কাস আলী ও মাতা কায়দাছুন নেছা। অতি শৈশব থেকেই বাস্তবতার সাথে তাঁকে প্রতি নিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছিল। দারিদ্রের নির্মমতা তাকে উচ্চ শিক্ষার পথ থেকে বঞ্চিত করলেও জীবন সংগ্রামী হামিদুর পিছিয়ে থাকতে চাননি। তাই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি যোগ দেন সেনাবাহিনীতে। ২৫শে মার্চে ঢাকায় পাকিস্থানী সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর অতর্কিত হামলা চালালে দেশপ্রেমিক হামিদুর রহমান দেশ মাতৃকার মুক্তির স্বপ্নে যোগ দেন মুক্তি বাহিনীতে । অংশগ্রহণ করেন একের পর এক যুদ্ধে।
১৯৭১ এর অক্টোবর। হামিদুর রহমান মুক্তিবাহিনীর সাহসী সদস্য হিসেবে যুদ্ধ করছিলেন সিলেট শ্রীমঙ্গল এলাকায়। এখানে অবস্থিত ধলই বি,ও,পি,তে পাকিস্থানীদের শক্ত ঘাটি দখল করতে পারলে মুক্ত করা যায় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। ২৮শে অক্টোবর অতি প্রত্যুষে মুক্তিবাহিনী শুরু করল আক্রমন। চা বাগানের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেলেন হামিদুর তাঁর দলের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কাইয়ুমের নির্দেশে একটি হালকা মেশিনগান সাথে নিয়ে। শত্রু ঘাটির একেবারে কাছে গিয়ে তিনি আকস্মিক হামলা চালালেন শত্রু দলের উপর। নিহত হল প্রতিপক্ষের অধিনায়কসহ কয়েকজন পাকিসহানী সৈন্য। শত্রু সৈন্যরা পরিস্থিতি সামলে নিয়ে শুরু করল পাল্টা আক্রমন। কিন্তু হামিদুর রহমান পিছু হটলেন না। প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে গেলেন। হঠাৎ একটি বুলেট এসে বিদ্ধ হল তাঁর কপালে। হামিদুর রহমান বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ হলেন। পাঁচ দিন অবিরাম যুদ্ধের পর মুক্ত হল ধলই বি,ও,পি। হামিদুর রহমানের আত্মত্যাগ রচনা করল আমাদের মুক্তির পথ। মুক্তিযুদ্ধে বিরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরুপ তিনি সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ট খেতাবে ভূষিত হন। সুদীর্ঘ ৩৬ বছর পর তাঁর দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং ১১ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে ঢাকার মিরপুরস্থ শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
এ মহান বীরের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বিগত ১৪-০১-২০০৮ তারিখে শহীদের নিজগ্রাম খোর্দ্দখালিশপুরের নাম পরিবর্তন করে 'হামিদ নগর' করা হয়েছে এবং হামিদ নগরে তাঁর নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজমাঠে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার বিভাগ, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় এর সার্বিক সহযোগিতায়৫৫,৯৮,৩৪০/৪৩ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছেবীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার । গ্রন্থাগারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ২৩৪৯ টি বই। এটি নির্মানে কারিগরি সহযোগিতা করেন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন জেলা পরিষদ, ঝিনাইদহ। এছাড়া তাঁর নিজ নামে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় । ঝিনাইদহ জেলা শহরের স্টেডিয়ামটি তাঁর নামে, বাংলাদেশ ডাক বিভাগ তাঁর স্মরনে একটি ডাক টিকিট প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার তাঁর পৈতৃক ভিটায় একটি পাকা বাড়ী নির্মাণ করেছে। এ নির্ভীক অকুতোভয় বীর সৈনিক এদেশের মানুষের হৃদয়ে চির জাগরুক হয়ে থাকবেন।
মহেশপুর উপজেলার সুন্দরপুর গ্রামে প্রখ্যাত জমিদার বংশের পুরধা তিনি।১৮৮৬ সালে তিনি জন্মগ্রহন করেন এই গ্রামে। তার বাবা সুরত আলি চৌধুরী এলাকার প্রখ্যাত ব্যাক্তিত্ত ছিলেন।তার জমিদারী আর অনেক বেশী বিস্তৃত করেন ফজ্লুর রহমান চৌধুরী। ১৯৩২ সালে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল আরল অফ ওয়েলিংটন এর কাছ থেকে এলাকার উন্নয়নে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ "খান সাহেব" উপাধি লাভ করেন।১৯৪০ এর পাট বিপ্লবেও তার বিরাট অবদান ছিল।১৯৫২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ৭২ বৎসর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।সুন্দরপুর গ্রামে গেলে আজও তার ঐতিহাসিক রাজকীয় বাড়িঘর ও কাছারিখানা দেখতে পাওয়া যায়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস